ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সাতকাহন

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F. Field-এর ২০১৩ সালে প্রকাশিত We Shall Fight On The Beaches : The Speeches That Inspired History শিরোনামের গ্রন্থটিতে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাসের সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ সংকলিত হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ব্রিটেনের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী জ্যাক ওয়াডিস পৃথিবীতে মানবসভ্যতার সড়ক নির্মাণের জন্য ৪টি ঘোষণাকে সহায়ক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তার প্রথমটি বিদায় হজে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর বাণী। যেখানে মহানবী তার বাণীতে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে গেছেন। 

দ্বিতীয়টি আমেরিকার গোটিসবার্গে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের বাণী। যে বাণী আমরা সবাই জানি। তৃতীয়টি কাল মার্কসের সাম্যবাদী মতবাদ এবং চতুর্থটি হলো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জ্যাক ওয়াডিস লন্ডনের ‘সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স’ নামক বিখ্যাত পত্রিকায় এমন বর্ণনা দেন। ২০১৩ সালে গ্রিন পাবলিশার্স ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ১২ ভাষার অনুবাদ জি. মওলার সংকলনটি বের হয়। তবে বলে রাখা আবশ্যক যে ১২ ভাষার মধ্যে উর্দু ভাষাও রয়েছে ১২ নম্বর তালিকায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় মাত্র আজ থেকে কয়েক বছর আগে।

আমাদের কার কতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ ও কতটুকু দেশপ্রেম? জাতীয় পতাকা থেকে বাশের খুঁটিটা সরিয়ে ফেলে দেখুন কী ঘটে? স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেখুন কী মেলে সেখানে? এবার আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ। জাতিসংঘের ইউনেস্কোর প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে ৩০ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্ব-ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংস্থার ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫ সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ কমিটি দু’বছর ধরে যাচাই বাছাই শেষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের সম্মতিক্রমে সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে তা অনুমোদন লাভ করে।

জাতিসংঘের ইউনেস্কোর এমন পথচলা সম্পর্কে ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হারুন-অর-রশিদের ‘৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৯৯২ সাল থেকে ইউনেস্কো বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে আসছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধর্মীয় উন্মাদনা, লুণ্ঠন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রভৃতি কারণে দেশে বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ বিনষ্ট বা ধবংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। সে জন্য শান্তির চেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হৃদয়ে লালন করতে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বেকোভার এ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। অন্যদের বেলায় যাই ঘটুক না কেন, বাংলাদেশের বেলায় এটা সত্য যে, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যদি কোনোভাবেই আওয়ামী লীগ সরকার আর ক্ষমতায় না আসত; তবে এতদিনে ধর্মীয় উন্মাদনায় ৭ মার্চ সমুদ্রের গর্ভে তলিয়ে যেত। অথবা যদি পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে কোনোদিন ক্ষমতায় না আসতে পারে, সে ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং সুদিন দেখে কাউকে কষ্ট করে এ দিবস পালনে আর কাজ নেই। আমি সরকারের পক্ষে বলছি তা নয়, বরং ৭ মার্চের সাতকাহন বর্ণনা করছি মাত্র। আর যাদের মনে এখনো সংশয় যে, এটা কীভাবে বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ হলো, তাদের অনুরোধ করব বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হারুন-অর-রশিদের এ বইটি পড়তে।

৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষণা। ১০ লক্ষাধিক মানুষের সম্মুখে বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর অলিখিত ১৮ মিনিটের ১১০৫টি শব্দের একটি ভাষণ। এ ভাষণের শব্দশৈলী ও গীতিময়তার কারণে কবি নির্মলেন্দু গুণ মহাকাব্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন মহাকবি। এ সব কথা আর শুনিয়ে লাভ কী। একটা সময়ে আপনারা তো কেড়ে নিয়েছেন আমাদের নিকট থেকে আমাদেরই মুক্তির বজ্রকণ্ঠ। বেতার টেলিভিশনেও তা প্রচার হতে দেননি। তখন মার্চ মাস বাঙালির কাছে নিষিদ্ধ ছিল। এখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো বলতে ইচ্ছে করে- ‘মার্চ মাস কেমন করে যে বাঙালি হয়ে গেল তা শুধু বিস্ময় নয়, গবেষণারও বিষয়’।

৭ মার্চের ভাষণ থামালে প্রজন্ম যুদ্ধে যাওয়ার সাহস পাবে কোথা থেকে! বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী তো অসমাপ্তই রয়ে গেছে, আগামী প্রজন্ম এটাকে সমাপ্ত করবে। বঙ্গবন্ধু মরেননি। ওই তো শোনা যাচ্ছে, ৭ মার্চের যুদ্ধে যাওয়ার ভাষণ। ৭ মার্চকে হত্যা করা যায়নি- কোনোভাবে তাকে আর হত্যা করা যাবেও না।

তৌহিদ-উল ইসলাম : শিক্ষক, গীতিকার ও শিশুসাহিত্যক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ